অন্ধকার

 


আমার বাড়ির জমিটা অনেকটা বড়। মাঝখানে বাড়ি, বাদবাকিটা পুরো বাগান। সারি সারি সুপারি গাছ দিয়ে জমিটা ঘেরা। বাগানে চারটে নারকেল গাছ, একটা লিচু গাছ, ছটা আম গাছ, দুটো পেয়ারা গাছ, একটা আতা গাছ ও নানা রকম ফুল গাছ আছে। চারিদিক খোলামেলা, সারাদিন ফুরফুরে হাওয়া, দিনের বেলায় সূর্যের আলোয়ে ঘর ভরে উঠত। দেশভাগ হবার সময়, আমার ঠাকুরদা কিছু পরিমাণ অর্থ নিয়ে এ দেশে চলে আসে। তখন, ঠাকুরদা এদেশের এক দুঃসম্পর্কীয় আত্মীয় মারফত এই জমিটা কেনে। ঠাকুরদার মুখে শুনেছিলাম, ওদেশে তারা নাকি জমিদারের নায়েব ছিল। আমার প্রপিতামহ ধীরে ধীরে টাকা-পয়সা জমিয়ে বিশাল অর্থের মালিক হয়। তিনি খুব দয়ালু মানুষ ছিলেন। সেযুগে যেকোনো উৎসবে আমাদের বাড়িতে পাঁচগ্রাম বসে খেত। ছোটবেলায় যখন এইসব কথা শুনতাম, আশ্চর্য হতাম। আমি নায়েব বংশের নাতি! গর্বে বুক ফুলে উঠত। মাঝে, আফশোস হতো! যদি আমরাও বড়লোক হতাম! কি ভালোই না হত! এখন পুরোটাই ভাওতা বলে মনে হয়। ঠাকুরদার বানানো গল্প! ও দেশ থেকে যারাই এদেশে এসেছে তারা সবাই নাকি বিশাল অর্থের মালিক ছিল! ভয়ে সবকিছু ছেড়ে এদেশে পালিয়ে এসেছে! এখন তারা সবাই আফসোস করে।

 অনেকদিন আগেই আমার ঠাকুরদা গত হয়েছে। তিনি এদেশে পোস্ট অফিসে চাকরি করতেন। জমি কিনে; একতলা দালান বাড়ি বানিয়ে ছিলেন। আমার বাবা সেই বাড়িটাকে দোতলা করে। আমার বাবা এক টেলিকম সংস্থায় চাকরি করতেন। এখন রিটায়ার হয়ে গেছেন। আমি একটা বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করি। কোম্পানির সেলস্ ডিপার্টমেন্টৈ আছি। মোটামুটি ইনকাম হয়, তবে আরেকটু হলে ভালো হতো! আমার ছেলেটাকে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করিয়েছি। একটা প্রাইভেট টিউশানে ভর্তি করিয়েছি। ছেলের খরচ, বউয়ের দাবিদাওয়া, বাবা-মার ওষুধ! আর পেরে উঠছি না!যেভাবে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে! খরচাও বাড়ছে। বাবা পেনশন পায় ঠিকই, সে টাকায় চিরে'ও ভেজে না। বাবাকে বললাম, "এত বড় জমির একটা দিক যদি প্রোমোটারকে দি, তাহলে বেশ টাকা পয়সা আসে!"

 - "দেখ, কি করবি! যেটা ভালো বুঝিস, সেটাই কর!"

সাতটা সুপারি গাছ, একটা নারকেল গাছ, দুটো আম গাছ ও একটা লিচু গাছ কাটা পরল। তৈরি হল ফ্ল্যাট। বেশ ভালো পরিমাণ টাকা পেলাম। দুটো ফ্ল্যাট ও পেলাম। চাকরিটা ছেড়ে দিলাম। রোজরোজ মালিকের গালিগালাজ শুনতে ভালো লাগেনা। ব্যবসা শুরু করলাম। কনস্ট্রাকশন বিজনেস। এক বন্ধুর সাথে শুরু করলাম পার্টনার হিসেবে। এখন, পঁয়ত্রিশ টাকা চালের জায়গায় পঞ্চাশ টাকায় চাল কিনি। পাড়ার মুদিখানার দোকান থেকে এখন আর মাসকাবারি জিনিসপত্র কিনি না। অনলাইনে অর্ডার দি। ওরা বাড়ি এসে পৌঁছে দিয়ে যায়। ছেলেকে পাড়ার ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল থেকে ছাড়িয়ে, শহরের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করালাম। ছেলেটা বড্ড মিষ্টি খেতে ভালোবাসে। এখন ফ্রিজে মিষ্টি বারোমাস থাকে। আমার বউ সারপ্রাইজ পেতে খুব পছন্দ। আগে পারতাম না, এখন আমিও মাঝে মাঝে সারপ্রাইজ দি। বউয়ের হাসি কার না ভালো লাগে! এখন রাত'ও বেশ ভালো কাটে। তবে, আরেকটু হলে ভালো হতো! 

 একটা সমস্যা হলো, ফ্ল্যাট থাকার জন্য বাড়ির একটা দিক অন্ধকার হয়ে গেল। ওই দিক দিয়ে আর আলো বাতাস আসে না। তবে তাতে বিশেষ সমস্যা হয় না! পরিবার নিয়ে ভালো আছি, এটাই বড় কথা!


এক বন্ধু বলল, "তোর বাড়ির এত জায়গা! আরেকটা দিক প্রোমোটারকে দিয়ে দে! শুধু শুধু জায়গাটা নষ্ট হচ্ছে! ভালো দাম পাবি!" আমিও ভেবে দেখলাম, বন্ধু ঠিকই তো বলেছে। শুধু শুধু একটা দিক পড়ে রয়েছে! আরেকটা দিক প্রোমোটার কে দিয়ে দিলাম। এবার আর বাবার অনুমতি নিলাম না। বাবার বয়স হয়েছে। যাইহোক বাবার একমাত্র ছেলে আমি! সব তো আমারি! আটটা সুপারি গাছ, একটা নারকেল গাছ, একটা আম গাছ ও দুটো পেয়ারা গাছ কাটা পড়ল। বাড়ির আরেকটা দিকে তৈরি হল ফ্ল্যাট। এবার ফ্ল্যাটের এর পরিবর্তে পুরোটাই টাকা নিলাম। পঞ্চাশ টাকার চাল আমরা আর খাইনা। নব্বই টাকার বাসমতি চাল কিনি। ছেলেকে অনলাইন কোচিং এ ভর্তি করিয়েছি। শুনেছি, সেসব কোচিংয়ে নাকি বড় বড় অভিনেতা, বিজনেসম্যানের ছেলেমেয়েরা পরে। ছেলের এখন মিষ্টি খেতে খেতে অরুচি ধরে গেছে। এখন ছেলে অনলাইনে বিদেশী বিদেশী খাবার অর্ডার করে। বউয়ের জন্মদিনে সারপ্রাইজ হিসেবে একটা গাড়ি দিয়েছি। এখন আর আমায় 'ওগো' বলে ডাকে না; মাঝে মাঝে হঠাৎ হঠাৎ গালে চুমু খেয়ে চলে যায়। মুখে রাগ দেখালেও,আমার এসব ভালোই লাগে। এখন আমার রঙিন রাত কাটে। তবে আরেকটু হলে ভালো হতো!

এখন বাড়ির দুই দিক, অন্ধকার। ফ্লাটের জন্য আলো বাতাস ঢুকতে পারে না। আমার বাড়িটা কেমন একটা অন্ধকার হয়ে থাকে। সারাদিন গুমোট হয়ে থাকে। তবে তাতে কি! পরিবার নিয়ে রাত খুশিতে কাটে! 


দুই বছর আগেই বাবা মারা গেছে। এখন আমি প্রমোটিং করি। আমি ও আমার শালা দুজনে পার্টনার। শালা বললো, "তোমার বাড়ির, পিছনের জমিটা ফাঁকাই আছে, ওটা দিয়ে ব্যবসা শুরু করি" আমি ভাবলাম, দুইদিকে ফ্ল্যাট আছে, পেছনের দিকটা তো ফাঁকা! প্রমোটিং -য়ে কাঁচা টাকা! পুরোটাই লাভ! পাঁচটা সুপারি গাছ, দুটো আম গাছ, একটা নারকেল গাছ ও একটা আতা গাছ কাটা পড়ল। নতুন ফ্ল্যাট তৈরি হলো। প্রচুর লাভ হল। আরো দুটো দামী গাড়ি কিনলাম। সিনেমায় দেখেছি এই গাড়িতেই নায়ক তার নায়িকা কে নিয়ে লংড্রাইভে যায়। স্টেশন চত্বরে একটা ফ্ল্যাট কিনলাম।নব্বই টাকার চাল খাইনা, একশো সত্তর টাকার চাল আসে। ছেলেকে একটা বড় বেসরকারি কলেজে ভর্তি করেছি। কলেজ তো নয়, পুরো রাজপ্রাসাদ! বউয়ের বাপের বাড়িটা সাজিয়ে দিয়েছি। দুটো কাজের লোক বউয়ের সেবা করে। বউ আমায় জড়িয়ে ধরে। আমার রাত ঝলমলে কাটে। তবে আরেকটু হলে ভালো হতো!

এখন আমার বাড়ির একদিক দিয়ে আলো বাতাস ঢোকে। বাড়িটা এখন প্রায় অন্ধকার হয়ে গেছে। সারাদিন ভ্যাপসানো, গুমোট হয়ে থাকে। তবে, টাকার অদ্ভুত ক্ষমতা আছে। ছোটবেলায় শুনতাম, টাকা দিয়ে সব কিছু কেনা যায় না । যারা এসব কথা বলে তারা মিথ্যুক! তারা হয় গরীব, না হয় অন্যের উপরে উঠে যাওয়া, তাদের সহ্য হয় না! আমি আরো টাকা কামাতে চাই! এ এক নেশা! ভালো থাকার নেশা! আমি আরো এই নেশায় পড়তে চাই! 


আমার নেশায় আমি বাড়ির একমাত্র ফাঁকা জায়গায় আমি ফ্ল্যাট তৈরি করি। তিনটে সুপারি গাছ একটা আম গাছ একটা নারকেল গাছ কাটা পড়ল। চারিদিকে শুধু টাকা আর টাকা! ছেলে সারাদিন বন্ধু নিয়ে মত্ত থাকে। মাঝে মাঝে বাড়িও ফেরে না। বউকে সারপ্রাইজ দিলে আর আগের মতো খুশি হয় না! সবই একঘেয়ে হয়ে গেছে। আমি ভালো নেই। 

আমার বাড়ির চারিদিকে অন্ধকার। রঙিনে আমার চোখ ধাঁধিয়ে গেছে। আমার রাত, আগের রাত ভেবে কাটে।

Comments

Post a Comment