সরস্বতী মহাভাগে
মঙ্গলবার, ৫ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৯:
- কাকু, সরস্বতী পুজোর চাঁদা–
- এই নে, পাঁচ টাকা ধর।
- পাঁচ টাকায় হবে না কাকু; বাজারের দাম বাড়ছে, কমসে কম কুড়ি টাকা তো দিতেই হবে–
বড়'রা দুর্গাপুজো, কালীপুজো, এছাড়া বিভিন্ন পুজো সংঘঠিত করে, তবে ছোটরাই বা বাদ যায় কেন! আমরাও বড়দের মতো পুজো সংঘঠিত করব। তাই হয়তো, ভগবান অনেক ভেবে সরস্বতী পুজোটা শুধু আমাদের জন্য করেছে। সরস্বতী পুজো বাঙ্গালীদের পঞ্জিকায় এক-দুই দিন থাকে।
কিন্তু ছোটদের পুজো দুই-তিন সপ্তাহের। তিন-চার বছর আগেকার কথা, প্রতিবছর বন্ধুরা মিলে নিয়মমাফিক পাড়ায় সরস্বতী পুজো করতাম। আজব ব্যাপার, মা সরস্বতী বিদ্যার দেবী হলেও, তার পুজোর দুই-তিন সপ্তাহ ধরে বইয়ের মুখ পর্যন্ত দর্শন করতাম না। তা বলে, মা সরস্বতীর আশীর্বাদে কোন কমতি ছিল না। দুই-তিন সপ্তাহ ধরে চলত পুজোর প্রস্তুতি।
এই প্রস্তুতির আগে একটা সভা ডাকা হতো। এই সভায় সবাই নিজের মতামত রাখতো; সেই মতামত যেন পার্লামেন্টে বসা নেতাদের মতামত'কেও হার মানায়। সভা হওয়ার পরের দিন থেকেই শুরু হতো চাঁদা কাটা।
পাড়ায় সরস্বতী পুজো করবো, চাঁদা কাটবো না; তা কখনো হয়! মায়ের হাজার বারণ সত্বেও' বন্ধু ডাক পেলে ছুটতাম চাঁদা কাটতে। এই চাঁদা কাটার মধ্য দিয়ে নিজেকে, কেমন পাড়ার বড় দাদা বলে মনে হতো। যেন চাঁদা নেওয়াটা আমাদের অধিকার। আর, যদি কেউ চাঁদা দিতে অস্বীকার করতো বা কেউ যদি দয়া করে হাতে দুই-এক টাকা গুঁজে দিত; সেই বাড়ির কলিং-বেলের খুব দুঃখ ছিল। কলিং-বেলটা এতবার বাজানো হতো, যে পরের দিন থেকে কলিং বেল নিজেকে বাজানোর সাহস করতো না। এইছিল আমাদের চাঁদা পর্ব। তারপর, শুরু হতো আমাদের পুজোর বাজার করা। দুই হাতে দুটো ব্যাগ নিয়ে যেতাম বাজারে। বাজার করা না তো! যেন গোটা বাজারটা তুলে নিয়ে আসলে, ভালো হতো। কে বলে, বড়রাই শুধু বাজারে গিয়ে দাম কষাকষি করতে পারে? ছোটরাও কম কিসের! বাজারে গিয়ে আমাদের হিসাব করা দেখে, স্বয়ং দেশের অর্থমন্ত্রী'ও লজ্জা পেয়ে যাবে। এর মাঝে দুই-এক টাকা বাঁচিয়ে, চুপিসারে দুই-তিন জন মিলে (সবাই নয়) পেটপুজো করার আনন্দটা, পাঁচতারা রেস্তোরা দামি খাবার খাওয়ার আনন্দকে নিঃসন্দেহে হারাতে পারে। এতে হয়তো পেট ভরতো না, তবে ভক্তি ভরে পুজো করা হতো। এরপর, সবাই মিলে যেতাম ঠাকুর আনতে। অবশ্য, সাথে বড়রা থাকতো। সবাই মিলে চিৎকার করতে করতে ঠাকুর আনতাম,"সরস্বতী মাই কি জয়–"। এই চিৎকারে মা সরস্বতীর কান'ও ঝালাপালা হয়ে যেত; এতে অবশ্য, বেশ মজাই পেতেন দেবী। এরপর, তৈরি হতো মণ্ডপ অর্থাৎ প্যান্ডেল। পাড়ার একটি জনপূর্ণ রাস্তার পাশের সংকীর্ণ ফাঁকা জায়গায় প্যান্ডেলটি তৈরি হতো। হুকুম ছিল, সবাই সবার নিজের বাড়ি থেকে দুটি করে শাড়ি দেবে। আর এইভাবেই, সবার মায়ের শাড়ি দিয়ে সেজে উঠতো আমাদের প্যান্ডেল। তারপর, পাড়ার এক ইলেকট্রিক কাকুকে (ইলেকট্রিক মিস্ত্রি) দিয়ে লাইট লাগানো হতো। সারি সারি দেওয়ালে ঝোলানো টুনি (টুনি লাইট), যেন আগন্তুক এর অপেক্ষায় মুখ বাড়িয়ে আছে। তারপর অবশেষে, ঠাকুর নিয়ে এসে মণ্ডপে রাখা হতো। মায়ের (মা সরস্বতী) মুখ দেখে মনে হতো, যেন মা সরস্বতী তার অবুঝ ছেলেদের কান্ডকারখানা দেখে বেজায় হাসছে।
এখন আমরা বড় হয়েছি, শৈশবের স্মৃতি অন্যকে গল্প বলার মধ্যেই, এখন সীমাবদ্ধ থাকে। সবাই নিজের কাজে ব্যস্ত; এই ব্যস্ততার যাঁতাকলে পরে, যেন সেই দিনগুলো নিরুদ্দেশের খাতার পাতা ভরাট করছে। ফেসবুক যুগে মানুষ ডিজিটাল হয়েছে, এখন ফেসবুকে কিংবা হোয়াটস্অ্যাপে স্ট্যাটাস্ দিয়ে সরস্বতী পুজো হয়। সবার পড়াশোনার চাপ, কাজের ব্যস্ততায় সেই চাঁদা কাটার দিনগুলো, বছরের তালে কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। এতে অবশ্যই, নিশ্চিন্তে থাকে পাড়ার লোকেরা। কিন্তু আজও শুধু অপেক্ষা করে, ওই ফেলে আসা গলির পথ টুকু।
Comments
Post a Comment