"আ'মরি বাংলা ভাষা"

(bengali magazine online reading free./বাংলা ম্যাগাজিন। Bengali poem, Bengali prose, Bengali article,)



কথায় আছে,"আজ যা বাঙালিরা ভাবে, কাল তা ভারতবাসী ভাবে এবং তার পরের দিন গোটা বিশ্ববাসী ভাবে"-কিন্তু সেই বাঙ্গালীদের মধ্যে বাংলা কোথায়? নিজেদের হাতে আয়তঘনাকৃতি, চ্যাপ্টা একটা পর্দা; তার মধ্যেই ইংরেজি বর্ণমালা ফুটে ওঠে, সেই অক্ষর গুলি কে স্পর্শ করলে তা ওই চ্যাপ্টা, আয়তঘনাকৃতি বস্তুর উপর ফুটে ওঠে। এটাই নাকি লেখা; যাকে বলে ডিজিটাল লেখা। অনেকটা ইংরেজি অক্ষর দিয়ে বাংলায় ভাব প্রকাশ করা। বলাবাহুল্য তার মধ্যে বাংলার ভাব কতটুকু প্রকাশ হয়, তা নিয়ে আমার মনে সন্দেহ আছে। প্রকাণ্ড পৃথিবীর মধ্যে সাত রাজার ধন এক মানিক সম।
খ্রিস্টীয় দশম শতাব্দীতে বাংলা সাহিত্যের সূচনা। সেই সময় কার রচনা হল চর্যাপদ -অধিকাংশ পদে লক্ষ্য করা যায় ষোল মাত্রার চৌপাই ছন্দ। যা নাকি বাঙালি জাতি ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য সম্পদ। বাঙালিরা সেটাই সযত্নে আপন মনে ভুলতে চলেছে।
যদি আমি উনিশ শতকে জন্মাতাম! হিন্দু কলেজে রাজনারায়ণ বসু, ভূদেব মুখোপাধ্যায়, মাইকেল মধুসূদন দত্তের সহপাঠী হতাম। যদি আমার সামনে মহাকবি মধুসূদন দত্ত, তার 'মেঘনাথবধ কাব্য' রচনা করত। তার প্রতিটি উপমার যদি সাক্ষী হতাম। চিৎকার করে বলতাম,
        "দাঁড়াও পথিকবর, জন্ম যদি তব বঙ্গে;
              তিষ্ঠ ক্ষণকাল"
সম্ভবত, প্রথমই মহাকবি মধুসূদন দত্ত নবজাগরণের নারী শক্তি, নারী চেতনার প্রতীক ছিল। তিনি তাঁর কাব্য গুলিকে কলম হিসেবে ব্যবহার করে, বলতে চাইছেন নারী স্বাধীনতার কথা। 'তরোয়াল এর চেয়েও, কলম শক্তিধর' তা বুঝতে পারি।
সেই বাংলার আজ সংকটময় দিন। উনিশ শতকে দুই-চারটি ইংরেজি জানা পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত, জ্ঞানী বাঙালি বাবুদের 'ভদ্রলোক' বলে ব্যঙ্গ করা হতো। বলা বাহুল্য, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে'ও 'গোলদিঘির গোলামখানা' বলে ব্যঙ্গ করতে ছাড়েনি।
কিন্তু আজ ইংরেজি ভাষা অবগত করতে না পারলে জনসমাগমে অপদস্ত হতে হয়। তার অবশ্য, কারণ অনেকটা আমরাই। একবিংশ শতাব্দীতে অন্যান্য ভাষায় জ্ঞান না থাকলে; তা দন্ডনীয় অপরাধ সম। অথচ এই দৌড়ের জন্য বাংলা হারিয়ে যাচ্ছে, সেই দিকে নজর দেওয়ার মন্দ সময় কারোর নেই। 'তুমি পূর্ণ, আমি শূন্য' -বাংলা হয়তো একা মনে তাই বলছে।

সেদিনকার কথা, আমি ট্রেনে করে আমার এক আত্মীয়ের বাড়ি হতে ঘরে ফিরছি। ট্রেনে আমার পাশের সিটে একটি ছোট ছেলে তার মাকে কৌতুহল ভাবে জিজ্ঞাসা করছে,"মা আমরা কোথায় যাচ্ছি?" মা রেগে আগুন; হাজার হাজার লিটার জল দিয়েও কি সে আগুন নেভানো যাবে কিনা, সে নিয়ে আমার মনে সন্দেহ আছে। ইতিমধ্যেই, ছেলেকে বকাবকি শুরু করে দিয়েছে। প্রথমে বকার কারণ আমি ঠাওর করতে পারিনি। পরে বুঝতে পারি, ছেলেটি বাংলায় কথা বলছে। স্কুলে কড়া নির্দেশ স্কুলে ইংরেজিতে কথা বলার পাশাপাশি, বাড়িতেও ইংরেজিতে কথা বলতে হবে। এতে নাকি ইংরেজি ভাষায় দক্ষ ও শ্রুতিমধুর হবে। ঘটনাটি, মনে আরও একবার পুনরাবৃত্তি করলে দমফাটা হাসির উপক্রম হবে। সেই আশঙ্কায় কোনরকমে ব্যাপারটিকে সামলে ঠিক হয়ে থাকার চেষ্টা করছিলাম। ট্রেন কামরার আর বাকি লোকগুলোকে দেখে কোন ভিন্ন আচরণের সন্দেহ হলো না। সবাই হয়তো এসব ঘটনার সাথে নিত্য দিনের পরিচিত। কারুর মুখে  বিস্মিত ভাব না দেখে, অতএব আমি আমার কাজে মনোনিবেশ করলাম।


ঊনবিংশ শতাব্দীতে নতুন করে বাংলা সাহিত্যের প্রসার ঘটে। মনে হয় একটু শুয়োপোকা তার দীর্ঘ জীবনযাত্রার অবসান ঘটিয়ে, নতুন করে প্রজাপতি হয়ে ডানা মেলে দিশাহীন ভাবে এ'ফুল থেকে ও'ফুল ঘুরছে। তারই মধু সংগ্রহ করছি আমরা। নতুন ছন্দে সৃষ্টি হচ্ছে অমর সাহিত্যের। অনেক ঘাত প্রতিঘাত, দ্বন্দ্ব এলেও; যেমন একটি নদী, সাগরে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য ঠিক তেমন। দেবদূতের মতো বাংলায় নবজাগরণের আলো নেমে আসে এ বঙ্গভূমিতে। যদুনাথ সরকার বলেছিলেন, "ব্যাপ্তি ও গভীরতার দিক থেকে তা ইউরোপীয় রেনেসাঁস কে ছাপিয়ে গিয়েছিল"

আজ ইংরেজি ভাষা, বাংলা ভাষাকে ঘরে শোপিস্ হিসেবে আলমারিতে সাজিয়ে রাখবে বলে দৃঢ় সংকল্প নিয়েছে। দূর-দূরান্ত থেকে লোক আসবে, ওই সাজিয়ে রাখা শোপিস্ টি দেখতে। যদি বাঙালির মুখ থেকেই বাংলা কেড়ে নেওয়া হয়, তবে বাঙালির রইল কি? ভেবে ভালো লাগে যে এই বাংলাকে আঁকড়ে ধরে, কত না সাহিত্যিক, কত না শিল্পী অমর সৃষ্টি করে গেছে। সেই বাংলা আজ বৃদ্ধাশ্রমের পথে। এখন সামান্য বাংলায় সিনেমা দেখার জন্য ভিন্ন ভাষা জানা আবশ্যক হয়ে পরে। মাঝে মাঝে, বোঝা দায় হয়ে পড়ে, আমি কি সত্যি বাংলা সিনেমা দেখছি, নাকি অন্য ভাষার সিনেমা দেখছি! তবে, কি বাংলার'ও দিন শেষ হয়ে আসছে?

এখন মোবাইল ফোনে'ও টাইপ করে কথা বলা যায়। সেই কথার মধ্যে কতটা আবেগ আছে, তা বোঝা দায়! অনেকে ‘বাং-রাজী’ -তে কথা বলে, অর্থাৎ বাংলা-ইংরেজি ভাষার মিশ্রণ। মাঝে মাঝে, সেই মিশ্রণে হিন্দি ভাষার'ও প্রবেশ ঘটে। তার মধ্যে বাংলার ভাগ ও ইংরেজির ভাগ কতটা, তা বোঝা কঠিন হয়ে পড়ে! "কথায় কথায় বাট (but), পুরোটা বলতে গেলেই ফাট"
মাঝে মাঝে ভেবে শঙ্কিত বোধ করি যে, আমাদের পরের প্রজন্ম কিংবা তারপরের প্রজন্ম কিংবা তার'ও পরের প্রজন্ম বাংলা কে ভুলে যাবে না তো? বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্র, মধুসূদন, নজরুল প্রমুখদের মনে রাখবে তো! তবু, মাঝে মাঝে দেখে ভালো লাগে, এখনো অনেকে বাংলাকে নিয়ে ভাবে।

তবে, কি বাংলারও যুগের অন্তর ঘটবে! যদি একটি গাছ কেটে ফেলা হয়, তার শিকড় মাটির ভেতরে থেকে যায়। সবাই যদি বাংলার পায়ে, লাজুক ছেলের মত নতজানু ভাবে এসে দাঁড়ায়, হয়তো 'বাংলা' অভিমানী মায়ের মত মনে মনে বলবে, "যদি সন্তান ঘুমের ঘোরে মায়ের গায়ে পদাঘাত করে, তবে সেটা কি সন্তানের দোষ!" এই বলে দুহাত বাড়িয়ে দেবে।

আমি'ও জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে বলবো,

"আমি বেদুইন, আমি চেঙ্গিস,
 আমি আপনারে ছাড়া, কাহারে করিনা কুর্নিশ!"

                                   (কাজী নজরুল ইসলাম)

হয়তো এই ভাবেই, সব অভিমান সব অভিযোগের বাঁধন ছিন্ন করে এক হয়ে যাবে বঙ্গভূমি।

                                           
                                                            বিষান ব্রহ্ম।

Comments

  1. Replies
    1. ধন্যবাদ, আর আমাদের সঙ্গে থাকতে সাবস্ক্রাইব করুন।

      Delete
  2. অসাধারণ একটা লেখা।মন ছুঁয়ে গেল ।

    ReplyDelete
  3. ধন্যবাদ। আমাদের সঙ্গে থাকতে সাবস্ক্রাইব করুন।

    ReplyDelete

Post a Comment